জানাজার নামাজের ইমামতির নিয়ম আরবি সহ উল্লেখ।

By G. Kibria

Published on:

জানাজার নামাজের ইমামতির নিয়ম আরবি সহ।

এই লেখাটিতে জানাজার নামাজের ইমামতির নিয়ম আরবি সহ উল্লেখ করা হয়েছে। জানাজার নামাজ ইসলামী শরিয়তের একটি গুরুত্বপূর্ণ ইবাদত। এটি ফরজে কিফায়া, অর্থাৎ কিছু মুসলমান এই নামাজ আদায় করলে বাকিদের দায়িত্ব মুক্ত হয়। জানাজার নামাজ সাধারণত একজন ইমামের নেতৃত্বে জামাতের সাথে পড়া হয়। মুসল্লিরা বেজোড় সংখ্যক কাতারে সারিবদ্ধ হয়ে এই নামাজ আদায় করেন।

এটি চার তাকবিরের নামাজ, যা দাঁড়িয়ে পড়তে হয় এবং সালাম ফেরানোর মাধ্যমে শেষ হয়। নামাজ শেষে মৃত ব্যক্তিকে গোরস্থানে নিয়ে গিয়ে ইসলামী রীতি অনুযায়ী কবরে দাফন করা হয়। এই লেখায় জানাজার নামাজে ইমামতির নিয়ম, দোয়া, নিয়ত এবং সংশ্লিষ্ট বিধান বিস্তারিতভাবে তুলে ধরা হলো।

জানাজার নামাজ মৃত ব্যক্তির জন্য দোয়া করার একটি বিশেষ ইবাদত। এটি মুসলিম সম্প্রদায়ের মধ্যে ঐক্য ও সম্মান প্রকাশের একটি মাধ্যম। ইসলামে মৃত ব্যক্তির প্রতি শ্রদ্ধা ও তার মাগফিরাতের জন্য দোয়া করা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। জানাজার নামাজের মাধ্যমে মুসলমানরা আল্লাহর কাছে মৃত ব্যক্তির ক্ষমা ও জান্নাত কামনা করেন। এই নামাজের মাধ্যমে জীবিতরাও মৃত্যুর স্মরণ পান এবং নিজেদের জীবনকে ইসলামের পথে পরিচালিত করার প্রেরণা পান।

জানাজার নামাজের ইমামতির নিয়ম

জানাজার নামাজে ইমামতির নিয়ম সঠিকভাবে পালন করা অত্যন্ত জরুরি। নিচে ধাপে ধাপে এই নিয়মগুলো বর্ণনা করা হলো:

নিয়ত ও প্রথম তাকবির

ইমামের পিছনে কাতারবদ্ধ হয়ে দাঁড়ানোর পর নিয়ত করতে হয়। নিয়তের পর প্রথম তাকবির “আল্লাহু আকবার” বলে হাত তুলে বুকে বাঁধতে হয়। এরপর সানা পড়তে হয়।

সানা:

سُبْحَانَكَ اللَّهُمَّ وَبِحَمْدِكَ وَتَبَارَكَ اسْمُكَ وَتَعَالَى جَدُّكَ وَجَلَّ ثَنَاؤُكَ وَلَا إِلَهَ غَيْرُكَ

উচ্চারণ: সুবহানাকা আল্লাহুম্মা ওয়া বিহামদিকা, ওয়া তাবারাকাসমুকা ওয়া তায়ালা জাদ্দুকা, ওয়া জাল্লা ছানাউকা ওয়া লা ইলাহা গাইরুকা।

অর্থ: হে আল্লাহ! তুমি পবিত্র, সকল প্রশংসা তোমার। তোমার নাম বরকতময়, তোমার মর্যাদা সুউচ্চ, তোমার প্রশংসা মহান এবং তুমি ছাড়া কোনো ইলাহ নেই।

দ্বিতীয় তাকবির ও দরুদে ইবরাহিম

দ্বিতীয় তাকবির বলার পর দরুদে ইবরাহিম পড়তে হয়, যা সাধারণ নামাজের তাশাহুদের সময় পড়া হয়।

দরুদে ইবরাহিম:

اللَّهُمَّ صَلِّ عَلَى مُحَمَّدٍ وَعَلَى آلِ مُحَمَّدٍ كَمَا صَلَّيْتَ عَلَى إِبْرَاهِيمَ وَعَلَى آلِ إِبْرَاهِيمَ إِنَّكَ حَمِيدٌ مَجِيدٌ اللَّهُمَّ بَارِكْ عَلَى مُحَمَّدٍ وَعَلَى آلِ مُحَمَّدٍ كَمَا بَارَكْتَ عَلَى إِبْرَاهِيمَ وَعَلَى آلِ إِبْرَاهِيمَ إِنَّكَ حَمِيدٌ مَجِيدٌ

উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা সাল্লি আলা মুহাম্মাদিও ওয়া আলা আলি মুহাম্মাদিন কামা সাল্লাইতা আলা ইবরাহিমা ওয়া আলা আলি ইবরাহিমা ইন্নাকা হামিদুম মাজিদ। আল্লাহুম্মা বারিক আলা মুহাম্মাদিও ওয়া আলা আলি মুহাম্মাদিন কামা বারাকতা আলা ইবরাহিমা ওয়া আলা আলি ইবরাহিমা ইন্নাকা হামিদুম মাজিদ।

অর্থ: হে আল্লাহ! মুহাম্মাদ (সা.) ও তাঁর পরিবারের উপর রহমত বর্ষণ কর, যেমন তুমি ইবরাহিম (আ.) ও তাঁর পরিবারের উপর রহমত বর্ষণ করেছ। তুমি প্রশংসিত ও মহিমান্বিত। হে আল্লাহ! মুহাম্মাদ (সা.) ও তাঁর পরিবারের উপর বরকত দান কর, যেমন তুমি ইবরাহিম (আ.) ও তাঁর পরিবারের উপর বরকত দান করেছ। তুমি প্রশংসিত ও মহিমান্বিত।

তৃতীয় তাকবির ও জানাজার দোয়া

তৃতীয় তাকবিরের পর মৃত ব্যক্তির জন্য বিশেষ দোয়া পড়তে হয়। সাধারণ জানাজার দোয়া নিম্নরূপ:

জানাজার দোয়া:

اللَّهُمَّ اغْفِرْ لِحَيِّنَا وَمَيِّتِنَا وَشَاهِدِنَا وَغَائِبِنَا وَصَغِيرِنَا وَكَبِيرِنَا وَذَكَرِنَا وَأُنْثَانَا اللَّهُمَّ مَنْ أَحْيَيْتَهُ مِنَّا فَأَحْيِهِ عَلَى الإِسْلامِ وَمَنْ تَوَفَّيْتَهُ مِنَّا فَتَوَفَّهُ عَلَى الإِيمَانِ بِرَحْمَتِكَ يَا أَرْحَمَ الرَّاحِمِينَ

উচ্চারণ: আল্লাহুম্মাগফিরলি হাইয়্যিনা ওয়া মাইয়্যিতিনা ওয়া শাহিদিনা ওয়া গাইবিনা ওয়া ছাগিরিনা ওয়া কাবিরিনা ওয়া যাকারিনা ওয়া উনছানা। আল্লাহুম্মা মান আহইয়াইতাহু মিন্না ফাআহয়িহি আলাল ইসলামি ওয়া মান তাওয়াফফাইতাহু মিন্না ফাতাওয়াফফাহু আলাল ইমান বিরাহমাতিকা ইয়া আরহামার রাহিমিন।

অর্থ: হে আল্লাহ! আমাদের জীবিত ও মৃত, উপস্থিত ও অনুপস্থিত, ছোট ও বড়, নারী ও পুরুষ সবাইকে ক্ষমা কর। হে আল্লাহ! আমাদের মধ্যে যাকে জীবিত রাখবে, তাকে ইসলামের উপর জীবিত রাখ। যাকে মৃত্যু দেবে, তাকে ঈমানের উপর মৃত্যু দাও। হে দয়াময়! তোমার রহমতের দ্বারা আমাদেরকে এই সওয়াব থেকে বঞ্চিত করো না।

নাবালক ছেলের জন্য দোয়া:

اللَّهُمَّ اجْعَلْهُ لَنَا فَرْطًا وَاجْعَلْهُ لَنَا أَجْرًا وَذُخْرًا وَاجْعَلْهُ لَنَا شَافِعًا وَمُشَفَّعًا

উচ্চারণ: আল্লাহুম্মাজ আলহু লানা ফারতাও ওয়াজ আলহু লানা আজরাও ওয়া যুখরাও ওয়াজ আলহু লানা শাফিয়াও ওয়া মুশাফফায়ান।

অর্থ: হে আল্লাহ! এই শিশুকে আমাদের জন্য নাজাতের পথপ্রদর্শক কর, তার জন্য আমাদের দুঃখকে প্রতিদান ও সম্পদের কারণ কর, তাকে আমাদের জন্য সুপারিশকারী কর, যা তোমার দরবারে কবুল হয়।

নাবালিকা মেয়ের জন্য দোয়া:

اللَّهُمَّ اجْعَلْهَا لَنَا فَرْطًا وَاجْعَلْهَا لَنَا أَجْرًا وَذُخْرًا وَاجْعَلْهَا لَنَا شَافِعَةً وَمُشَفَّعَةً

উচ্চারণ: আল্লাহুম্মাজ আলহা লানা ফারতাও ওয়াজ আলহা লানা আজরাও ওয়া যুখরাও ওয়াজ আলহা লানা শাফিয়াও ওয়া মুশাফফায়ান।

অর্থ: হে আল্লাহ! এই শিশুকে আমাদের জন্য নাজাতের পথপ্রদর্শক কর, তার জন্য আমাদের দুঃখকে প্রতিদান ও সম্পদের কারণ কর, তাকে আমাদের জন্য সুপারিশকারী কর, যা তোমার দরবারে কবুল হয়।

চতুর্থ তাকবির ও সালাম

চতুর্থ তাকবিরের পর একটু নীরব থেকে ডানে ও বামে সালাম ফিরিয়ে নামাজ শেষ করতে হয়। জানাজার নামাজে তাকবির দেওয়ার সময় হাত তুলতে হয় না, যা ঈদের নামাজের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য।

জানাজার নামাজের ইমামতির নিয়ত

জানাজার নামাজের নিয়ত অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। নিয়ত আরবিতে বা বাংলায় করা যায়। নিচে আরবি ও বাংলা নিয়ত দেওয়া হলো:

আরবি নিয়ত:

نَوَيْتُ أَنْ أُؤَدِّيَ لِلَّهِ تَعَالَى أَرْبَعَ تَكْبِير asnفَرْضَ الْكِفَايَةِ وَالثَّنَاءُ لِلَّهِ تَعَالَى وَالصَّلَاةُ عَلَى النَّبِيِّ وَالدُّعَاءُ لِهَذَا الْمَيِّتِ اقْتِدَاتُ بِهَذَا الإِمَامِ مُتَوَجِّهًا إِلَى جِهَةِ الْكَعْبَةِ الشَّرِيفَةِ اللَّهُ أَكْبَرُ

উচ্চারণ: নাওয়াইতু আন উয়াদ্দিয়া লিল্লাহি তায়ালা আরবাআ তাকবিরাতি ছালাতিল জানাজাতি ফারজুল কিফায়াতি আছছানাউ লিল্লাহি তায়ালা ওয়াছছালাতু আলান নাবিয়্যি ওয়াদ্দোয়াউ লিহাযাল মাইয়্যিতি ইক্তিদায়িতু বিহাযাল ইমামি মুতাওয়াজ্জিহান ইলা জিহাতিল কাবাতিশ শারিফাতি আল্লাহু আকবার।

অর্থ: আমি চার তাকবিরের সাথে ফরজে কিফায়া জানাজার নামাজ আল্লাহর জন্য, নবীর উপর দরুদ ও মৃত ব্যক্তির জন্য দোয়ার উদ্দেশ্যে এই ইমামের পিছনে কিবলামুখী হয়ে আদায় করছি। আল্লাহু আকবার।

বাংলায় নিয়ত: আমি চার তাকবিরের সাথে ফরজে কিফায়া জানাজার নামাজ কিবলামুখী হয়ে এই ইমামের পিছনে মরহুম/মরহুমা [নাম] এর জন্য দোয়ার উদ্দেশ্যে আদায় করছি। আল্লাহু আকবার। নিয়তে পুরুষের ক্ষেত্রে “লিহাযাল মাইয়্যিতি” এবং নারীর ক্ষেত্রে “লিহাযিহিল মাইয়্যিতি” বলতে হয়।

গায়েবী জানাজার নিয়ম

গায়েবী জানাজার নামাজ সাধারণত তখনই পড়া হয়, যখন মৃত ব্যক্তির জানাজা তার দেশে পড়া সম্ভব হয়নি। উদা হরণস্বরূপ, কোনো মুসলিম কাফের রাষ্ট্রে মারা গেলে এবং তার জানাজা পড়া না হলে, গায়েবী জানাজা পড়া যায়। তবে, যদি একবার জানাজা পড়া হয়ে থাকে, তাহলে গায়েবী জানাজা শরিয়তসম্মত নয়।

হাদিসে বাদশাহ নাজাশির গায়েবী জানাজার উল্লেখ আছে, কারণ তার দেশে জানাজা পড়া হয়নি। তবে অন্য কোনো সাহাবীর জন্য রাসূল (সা.) গায়েবী জানাজা পড়েছেন, এমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায় না।

জানাজার নামাজে ভুল হলে করণীয়

যদি কেউ জানাজার নামাজে দেরি করে আসে, তবে তাকে ইমামের সাথে যোগ দিয়ে নামাজ সম্পন্ন করতে হবে। সম্ভব হলে চার তাকবির পূর্ণ করার চেষ্টা করতে হবে। তবে, যদি তা সম্ভব না হয়, তাহলে ইমামের সালামের সাথে সালাম ফিরিয়ে নামাজ শেষ করতে হবে। জানাজার নামাজ জামাতে পড়তে হয়, তাই এটি কাজা করার সুযোগ নেই।

জানাজার নামাজ শেষ হলে মৃত ব্যক্তিকে অবিলম্বে গোরস্থানে নিয়ে যেতে হয়। ইসলামী শরিয়ত অনুযায়ী কবর খনন করতে হয় এবং মৃতদেহ কাফন মুড়িয়ে কবরে শায়িত করতে হয়। কবরের গভীরতা এবং দিক সঠিকভাবে নির্ধারণ করা গুরুত্বপূর্ণ। পুরুষের ক্ষেত্রে মাথা কিবলার দিকে এবং নারীর ক্ষেত্রেও একইভাবে শায়িত করা হয়। দাফনের সময়ও দোয়া পড়া হয়, যাতে মৃত ব্যক্তির জন্য আল্লাহর রহমত কামনা করা হয়।

জানাজার নামাজ ইসলামের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ, যা মৃত ব্যক্তির জন্য দোয়া ও ক্ষমা প্রার্থনার মাধ্যম। এই নামাজের নিয়ম সঠিকভাবে পালন করা প্রত্যেক মুসলমানের দায়িত্ব। ইমামতির নিয়ম, নিয়ত, দোয়া এবং অন্যান্য বিধান সঠিকভাবে জানা থাকলে এই ইবাদত সহজে সম্পন্ন করা যায়। জানাজার নামাজ শুধু মৃত ব্যক্তির জন্যই নয়, জীবিতদের জন্যও মৃত্যুর স্মরণ ও আল্লাহর প্রতি ভয় জাগ্রত করে। তাই, প্রত্যেক মুসলমানের উচিত এই নামাজের নিয়ম সম্পর্কে জানা এবং তা সঠিকভাবে পালন করা।

যেকোনো তথ্যের আপডেট সবার আগে জানার জন্য উত্তর বিডির সোসাল একাউন্টগুলো অনুসরণ করুন। ধন্যবাদ আপনাকে।

ফেসবুক পেজFollow Us
হোয়াটসএপJoin us
ইন্সটাগ্রামJoin us
মিডিয়ামJoin us

Leave a Comment