বৃষ্টির গন্ধের কারন পেট্রিকর ও জিওসমিনের বিস্ময়কর কর্ম।

By G. Kibria

Published on:

বৃষ্টির গন্ধের কারন পেট্রিকর ও জিওসমিনের বিস্ময়কর কর্ম

বৃষ্টি নামলেই মনটা যেন একটু উড়ুউড়ু হয়ে যায়। জানালার কাছে দাঁড়িয়ে ঠান্ডা হাওয়ার সঙ্গে সেই চেনা মাটির গন্ধ নাকে এলেই মনে পড়ে শৈশবের ছুটোছুটি, বারান্দায় বসে মায়ের হাতের গরম চা, কিংবা প্রথম প্রেমের সেই বৃষ্টিভেজা দিন। কিন্তু এই গন্ধের পেছনে লুকিয়ে আছে এক অদ্ভুত বিজ্ঞান আর প্রকৃতির মেলবন্ধন। এই গন্ধের নাম পেট্রিকর, আর এর জন্য দায়ী একটি বিশেষ ব্যাকটেরিয়া, অ্যাক্টিনোমাইসেটিস, যা মাটিতে থেকে জিওসমিন নামের এক রাসায়নিক ছড়ায়। আজ আমরা এই গন্ধের রহস্য, এর বিজ্ঞান, আর আমাদের মনে এর প্রভাব নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করব।

পেট্রিকর কী

পেট্রিকর শব্দটি এসেছে গ্রিক শব্দ ‘পেট্রা’ যার অর্থ পাথর, আর ‘ইকর’ যার অর্থ দেবতাদের রক্ত। ১৯৬৪ সালে অস্ট্রেলিয়ান বিজ্ঞানী ইসাবেল জয় বেয়ার এবং রিচার্ড জি. থমাস প্রথম এই শব্দটি ব্যবহার করেন। তারা লক্ষ্য করেন, শুষ্ক মাটিতে বৃষ্টির প্রথম ফোঁটা পড়ার পর একটি স্বতন্ত্র গন্ধ ছড়ায়, যা মানুষের মনে প্রশান্তি আনে। এই গন্ধ শুধু মাটির কণা বা ভেজা পাতার নয়, এর পেছনে কাজ করে একটি জটিল প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া।

বৃষ্টি না পড়ার সময় মাটিতে থাকা অ্যাক্টিনোমাইসেটিস ব্যাকটেরিয়া নিষ্ক্রিয় থাকে। কিন্তু বৃষ্টির পানি মাটি ভিজিয়ে দিলে এই ব্যাকটেরিয়া সক্রিয় হয়ে ওঠে এবং জিওসমিন নামক একটি রাসায়নিক নির্গত করে। এই জিওসমিনই আমাদের নাকে এসে সেই পরিচিত ‘বৃষ্টির গন্ধ’ তৈরি করে। আশ্চর্যের বিষয়, মানুষের ঘ্রাণেন্দ্রিয় এই জিওসমিনের প্রতি এতটাই সংবেদনশীল যে, খুব অল্প পরিমাণ জিওসমিনও আমরা টের পাই।

বৃষ্টির গন্ধের কারন
বৃষ্টির গন্ধের কারন

বৃষ্টির গন্ধের কারন

জিওসমিন একটি জৈব রাসায়নিক যৌগ, যা প্রধানত অ্যাক্টিনোমাইসেটিস ব্যাকটেরিয়া উৎপন্ন করে। এই যৌগের গন্ধ মাটির মতো, কিন্তু তাতে আছে একটি সতেজতা, যা আমাদের মনে প্রকৃতির সঙ্গে সংযোগ তৈরি করে। জিওসমিন শুধু মাটিতেই নয়, কখনো কখনো পানির উৎসেও পাওয়া যায়, যেমন নদী বা হ্রদে। এ কারণেই কখনো পানির স্বাদ বা গন্ধে মাটির ছোঁয়া অনুভূত হয়।

বিজ্ঞানীরা জানান, জিওসমিনের গন্ধে একটি বিবর্তনীয় কারণও থাকতে পারে। প্রাচীনকালে মানুষ পানির উৎস খুঁজে বেড়াত, আর জিওসমিনের গন্ধ তাদের পানির কাছাকাছি নিয়ে যেত। এই গন্ধ আমাদের মস্তিষ্কে একটি প্রাচীন স্মৃতি জাগায়, যা আমাদের প্রকৃতির সঙ্গে আরও গভীরভাবে যুক্ত করে।

বৃষ্টির গন্ধ শুধু নাকে আসে না, এটি আমাদের মনেও ছোঁয়া লাগায়। এই গন্ধের সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমাদের ব্যক্তিগত স্মৃতি। কারও মনে পড়ে গ্রামের বাড়ির উঠোন, কারও মনে পড়ে স্কুলের বন্ধুদের সঙ্গে বৃষ্টিতে ভেজা। এই গন্ধ যেন একটি সময়যান, যা আমাদের ফিরিয়ে নিয়ে যায় অতীতে।

মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, পেট্রিকরের গন্ধ আমাদের মনে প্রশান্তি এবং আনন্দ জাগায়। এটি স্ট্রেস কমায় এবং মানসিক স্বস্তি দেয়। প্রকৃতির এই উপহার আমাদের মনে নতুন করে শুদ্ধ হওয়ার অনুভূতি জাগায়, যেন বৃষ্টির সঙ্গে আমাদের মনের ধুলোও ধুয়ে যায়।

বৃষ্টির গন্ধের উপাদান

উপাদানবিবরণ
পেট্রিকরবৃষ্টির পর মাটির স্বতন্ত্র গন্ধ, অ্যাক্টিনোমাইসেটিস ব্যাকটেরিয়া থেকে আসে।
জিওসমিনমাটির গন্ধের জন্য দায়ী জৈব যৌগ, অল্প পরিমাণেও মানুষের নাক টের পায়।
অ্যাক্টিনোমাইসেটিসশুষ্ক মাটিতে থাকা ব্যাকটেরিয়া, বৃষ্টিতে সক্রিয় হয়ে জিওসমিন ছড়ায়।
মানসিক প্রভাবপ্রশান্তি, স্মৃতি, শৈশবের অনুভূতি জাগায়।

বাংলাদেশের মতো কৃষিপ্রধান দেশে বৃষ্টি শুধু প্রকৃতির ঘটনা নয়, এটি জীবনের একটি অংশ। বৃষ্টির গন্ধ নিয়ে কবিতা, গান, আর গল্প লেখা হয়েছে। বাংলা সাহিত্যে বৃষ্টি প্রায়ই প্রেম, বিষাদ, বা নতুন শুরুর প্রতীক হিসেবে আসে। এই গন্ধ আমাদের সংস্কৃতির সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত।

বিশ্বের অন্যান্য সংস্কৃতিতেও বৃষ্টির গন্ধের প্রভাব দেখা যায়। ভারতের গ্রামাঞ্চলে এই গন্ধ কৃষকদের মনে আশা জাগায়। পশ্চিমা দেশগুলোতে পেট্রিকরকে প্রায়ই প্রকৃতির শুদ্ধিকরণের প্রতীক হিসেবে দেখা হয়। এমনকি পারফিউম শিল্পেও জিওসমিনের গন্ধ নকল করে সুগন্ধি তৈরি করা হয়।

পেট্রিকর ও জিওসমিনের ব্যবহার

জিওসমিন শুধু প্রকৃতির উপহার নয়, এটি বিভিন্ন শিল্পেও ব্যবহৃত হয়। পারফিউম তৈরিতে জিওসমিনের কৃত্রিম সংস্করণ ব্যবহার করা হয়। এছাড়া, খাদ্য ও পানীয় শিল্পে মাটির স্বাদ যোগ করতে জিওসমিন ব্যবহার হয়। তবে, অতিরিক্ত জিওসমিন পানিতে থাকলে তা পানির স্বাদ নষ্ট করতে পারে, যা পানি শোধনাগারের জন্য একটি চ্যালেঞ্জ।

বৃষ্টির গন্ধ শুধু আমাদের মনেই প্রভাব ফেলে না, এটি পরিবেশের জন্যও গুরুত্বপূর্ণ। বৃষ্টি মাটিকে সতেজ করে, গাছপালাকে পুষ্টি দেয়, আর অ্যাক্টিনোমাইসেটিসের মতো ব্যাকটেরিয়া মাটির উর্বরতা বাড়ায়। তবে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে অনিয়মিত বৃষ্টিপাত এই প্রাকৃতিক প্রক্রিয়াকে ব্যাহত করছে। তাই, পরিবেশ রক্ষায় আমাদের সচেতন হওয়া জরুরি।

উপসংহার

পেট্রিকর আমাদের শুধু একটি গন্ধই দেয় না, এটি প্রকৃতি ও মানুষের মধ্যে একটি অদৃশ্য সেতু তৈরি করে। জিওসমিন আর অ্যাক্টিনোমাইসেটিস এর এই বিস্ময়কর সমন্বয় আমাদের মনে শান্তি, স্মৃতি, আর আনন্দ জাগায়। পরের বার বৃষ্টি হলে একটু থামুন, গন্ধটি নিন, আর প্রকৃতির এই উপহারটি উপভোগ করুন। বৃষ্টির গন্ধ যেন আমাদের মনে করিয়ে দেয় পৃথিবী এখনো রহস্য আর সৌন্দর্যে ভরা।

যেকোনো তথ্যের আপডেট সবার আগে জানার জন্য উত্তর বিডির সোসাল একাউন্টগুলো অনুসরণ করুন। ধন্যবাদ আপনাকে।

ফেসবুক পেজFollow Us
হোয়াটসএপJoin us
ইন্সটাগ্রামJoin us
মিডিয়ামJoin us

Leave a Comment